৮.১ জিনতত্ত্ব
আমাদের জীবজগৎ অসংখ্য বৈচিত্র্য নিয়ে বিদ্যমান। আদিকাল থেকেই মানুষ তার জন্য উপকারী উদ্ভিদ ও প্রাণীদের নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে এসেছে। তোমরা ইতোমধ্যে হরিপদ কাপালীর আবিষ্কৃত হরিধানের নাম শুনেছ, তিনি তার ধানক্ষেতে অজানা প্রজাতির ধান দেখতে পেয়ে সেখান থেকে বীজ তৈরি করেন যা পরবর্তী কালে উচ্চফলনশীল জাত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তিনি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না জেনেই ধানের উচ্চফলনশীল বৈশিষ্ট্যটি তার পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তর করেছিলেন। আবহমানকাল জুড়েই আমাদের দেশের কৃষকেরা এরূপ করে আসছে।
প্রজনন জীবের একটি স্বাভাবিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রজননের মাধ্যমে মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত হয় এবং জীব তার নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখে। এভাবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে মাতা-পিতার বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরের প্রক্রিয়া বংশগতি (heredity) নামে পরিচিত। বংশগতির মৌলিক একক হলো জিন। তোমরা কোষের ক্রোমোজোমে যে ডিএনএ সম্পর্কে জেনেছ সেখানে জীবের জিনগুলো সজ্জিত থাকে। সাধারণত জিন দ্বারাই প্রজাতির বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। বিজ্ঞানের যে শাখায় জিনের গঠন, নিয়ন্ত্রণ, প্রকাশ, কার্যপদ্ধতি ও তার বংশানুক্রমিক সঞ্চালন পদ্ধতি ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে জিনতত্ত্ব (Genetics) বলে। এই অধ্যায়ে আমরা এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
৮.২ গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল ও তার গবেষণা
গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল (Gregor Johann Mendel, 1822-1884) তার গবেষণায় সর্বপ্রথম জীবের বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে স্থানান্তরের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছিলেন। এই বিজ্ঞানী (চিত্র ৮.১) ছিলেন বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রবাসী একজন ধর্মযাজক। দীর্ঘ সাত বছর তিনি মটরশুঁটি গাছের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বংশগতি সম্পর্কিত তার মতামত প্রকাশ করেন। কিন্তু মেন্ডেলের প্রকাশিত নিবন্ধটি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোকচক্ষুর অগোচরেই রয়ে যায়। মেন্ডেলের মৃত্যুর ১৬ বছর পর হিউগো দ্য ভিস, কার্ল করেন্স এবং এরিক স্কেরমেক নামে তিনজন বিজ্ঞানী পৃথকভাবে কিন্তু একই সময়ে মেন্ডেলের গবেষণার ফলাফল পুনরাবিষ্কার করেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো এ বিজ্ঞানীরা তাঁদের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করার পর মেন্ডেলের গবেষণা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। এভাবে মেন্ডেলের গবেষণার মাধ্যমে বংশগতির মৌলিক সূত্রের আবিষ্কার ও প্রকাশের মাধ্যমে যে ভিত্তি রচিত হয় তার উপর নির্ভর করে জীববিজ্ঞানে বংশগতিবিদ্যা বা জিনতত্ত্ব নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার বিকাশ ঘটে। এ কারণে মেন্ডেলকে বংশগতিবিদ্যার জনক (Father of Genetics) বলে অভিহিত করা হয়।
মেন্ডেনের গবেষণা ও জীবের বৈশিষ্ট্য নির্বাচন
জোহান গ্রেগর মেন্ডেল ব্যক্তি জীবনে একজন ধর্মযাজক হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন খাঁটি বিজ্ঞানী ছিলেন। বংশগতিবিদ্যা পরীক্ষার জন্য তিনি তার মঠের বাগানে নিয়ন্ত্রিত-পরাগায়নের মাধ্যমে সংকরায়ণ (Hybridization) করার জন্য মটরশুঁটি উদ্ভিদকে নির্বাচন করেন এবং 1856 সাল থেকে তাঁর গবেষণা শুরু করেন। মেন্ডেল তাঁর পরীক্ষার জন্য মটরশুঁটি গাছকে নমুনা হিসেবে মনোনীত করার পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। যেমন- (১) মটরশুঁটি গাছ একবর্ষজীবী হওয়ায় খুব কম সময়ের মধ্যেই সংকরায়ণ পরীক্ষার ফল পাওয়া যায়। (২) এটি একটি উভলিঙ্গী উদ্ভিদ এবং স্বপরাগায়নের মাধ্যমে যৌন প্রজনন সম্পন্ন করে। (৩) ফুলগুলো আকারে বড়ো হওয়ায় মটরশুঁটি গাছে অতি সহজেই সংকরায়ণ ঘটানো যায়। (৪) পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবককে ঘিরে দলমণ্ডল (Corolla) এমনভাবে সাজানো থাকে যে পরনিষেকের (Cross fertilization) কোনো সম্ভাবনা থাকে না। ফলে বিভিন্ন জাতের মটরশুঁটি উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যগুলো খাঁটি বা বিশুদ্ধ অবস্থায় থাকে। (৫) মটরশুঁটি গাছে একাধিক সুস্পষ্ট তুলনামূলক বিপরীত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তাই অপত্য বংশে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট প্রকাশ পরীক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। (৬) সংকরায়ণে সৃষ্ট বংশধরগুলো উর্বর (fertile) প্রকৃতির হওয়ায় সেগুলো নিয়মিত বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
মেন্ডেল বিভিন্ন উৎস থেকে 34 ধরনের মটরশুঁটি উদ্ভিদের বীজ সংগ্রহ করে আশ্রমের বাগানে প্রায় এক বৎসর প্রত্যেক ধরনের বীজের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা শেষে তিনি কাণ্ডের দৈর্ঘ্য, ফুলের অবস্থান, ফুলের রং, ফলের বর্ণ, ফলের আকৃতি, বীজের বর্ণ এবং বীজের আকৃতি এই সাতটি বৈশিষ্ট্যের (trait) প্রত্যেকটির জন্য দুটি করে বিপরীত লক্ষণসম্পন্ন মোট 14টি খাঁটি উদ্ভিদ নির্বাচন করেন। অর্থাৎ কাণ্ডের দৈর্ঘ্য বৈশিষ্ট্যের জন্য লম্বা ও খাটো এই দুটি বিপরীত লক্ষণ, ফুলের বর্ণ বৈশিষ্ট্যের জন্য সাদা ও বেগুনি এই দুটি লক্ষণ, বীজের আকৃতির জন্য গোলাকার ও কুঞ্চিত এই দুটি লক্ষণ ইত্যাদি (চিত্র ৮.২)। শুরুতে মেন্ডেল লম্বা এবং খাটো এই বিপরীত লক্ষণযুক্ত দুধরনের মটরশুঁটি গাছ নিয়ে তাঁর পরীক্ষা শুরু করেছিলেন। এটি যেহেতু শুধু কান্ডের দৈর্ঘ্য, এই একটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত উদ্ভিদ নিয়ে পরীক্ষা ছিল তাই এটিকে মনোহাইব্রিড ক্রস (monohybrid cross) বলা হয়ে থাকে (mono অর্থ একটি)।
পরীক্ষা শুরু করার আগে তিনি মটরশুঁটি গাছের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে নেন। এরপর শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত একটি লম্বা উদ্ভিদের সঙ্গে শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত একটি খাটো উদ্ভিদের কৃত্রিম পরাগসংযোগ ঘটান অর্থাৎ লম্বা উদ্ভিদের পরাগরেণু নিয়ে খাটো উদ্ভিদের গর্ভমুন্ডে স্থাপন করেন। লম্বা ও খাটো উদ্ভিদের মাঝে সংকরায়ণের পরেও সবকটি উৎপন্ন বীজ থেকে শুধু লম্বা উদ্ভিদ পাওয়া যায়। প্রথম সংকরায়ণের ফলে পাওয়া এই উদ্ভিদগুলোকে মেন্ডেল প্রথম প্রজন্ম বা F, বলে নামকরণ করেন। এবারে তিনি F, প্রজন্মের উদ্ভিদগুলোর নিজেদের মধ্যে পরাগসংযোগ করে সংকরায়ণ ঘটান। দ্বিতীয়বার সংকরায়ণের ফলে সৃষ্ট দ্বিতীয় প্রজন্ম F₂ তে 3:1 অনুপাতে লম্বা এবং খাটো উদ্ভিদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ F, বংশধরের দৃশ্যমান লম্বা উদ্ভিদের মাঝে কোনোভাবে খাটো উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য লুক্কায়িত ছিল, যেটি দ্বিতীয়বার সংকরায়ণের সময় বের হয়ে এসেছে।
পরবর্তী কালে মেন্ডেল বীজের বর্ণ (লক্ষণ হলুদ কিংবা সবুজ) এবং বীজের আকার (লক্ষণ গোলাকার কিংবা কুঞ্চিত) এই দুটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত মটরশুঁটি গাছ নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন, দুটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরীক্ষার কারণে এটিকে ডাইহাইব্রিড ক্রস (dihybrid cross, di অর্থ দুই) বলা হয়। একটি শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত হলুদ বর্ণ এবং গোলাকার বীজ উৎপন্নকারী উদ্ভিদের সঙ্গে অপর একটি শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত সবুজ বর্ণ এবং কুঞ্চিত বীজ উৎপন্নকারী উদ্ভিদের সংকরায়ণে দেখা গেল F, প্রজন্মের সবকটি উদ্ভিদই হলুদ বর্ণের এবং গোলাকার বীজ উৎপন্ন করে। F, প্রজন্মের উদ্ভিদগুলোর নিজেদের মধ্যে সংকরায়ন করে F2 প্রজন্মের মাঝে দেখা গেল, 16টি বংশধরের মধ্যে ৭টি হলুদ-গোল, ওটি হলুদ-কুঞ্চিত, ওটি সবুজ-গোল ও 1টি সবুজ-কুঞ্চিত বীজ উৎপন্নকারী উদ্ভিদ (ছবি দ্রষ্টব্য)।
প্রথম দৃষ্টিতে তোমাদের কাছে মেন্ডেলের পর্যবেক্ষণগুলোকে যথেষ্ট জটিল মনে হলেও ম্যান্ডেলের দুটি সূত্র ব্যবহার করে তুমি খুব সহজেই এই পর্যবেক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করতে পারবে। তার আগে তোমাকে জীবে প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত দু-একটি বিষয় জেনে নিতে হবে।
৮.৩ জীবে একট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ
মেন্ডেলের গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল জীবে প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ। তোমরা এর মাঝে জেনে গেছ যে জীবদেহে প্রাথমিক স্তরে জিনের মাধ্যমে বংশ হতে বংশান্তরে বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হয়। ফুলের রং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় মেন্ডেল লক্ষ করেন যে মটরশুঁটি ফুলের রং হয় সাদা নয়তো বেগুনি হয়, এদের মাঝামাঝি কিছু হয় না। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট জিন ফুলের রং নির্ধারণ করে থাকে। প্রতিটি স্বতন্ত্র উদ্ভিদের প্রত্যেকটি জিনের দুটি করে প্রতিরূপ আছে যার একটি পিতা এবং অন্যটি মাতার কাছ থেকে এসেছে। জিনের এই প্রতিরূপ দুটিকে অ্যালিল (Allele) বলা হয়। ডিপ্লয়েড জীবের দুটি অ্যালিল একই রকম বা ভিন্ন হতে পারে। যদি অ্যালিল দুটি একই রকম হয় তখন তাকে হোমোজাইগাস বলে, আর ভিন্ন হলে হেটারোজাইগাস বলা হয়। কোনো নির্দিষ্ট জীবের অ্যালিলগুলোকে তার জিনোটাইপ এবং দৃশ্যমান বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে তার ফিনোটাইপ বলে।
হেটারোজাইগাস জীবের ভিন্ন অ্যালাইল দুটির যে অ্যালাইলটির বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয় (অর্থাৎ ফিনোটাইপে প্রাধান্য বিস্তার করে) সেটি প্রকট জিন নামে পরিচিত। মেন্ডেলের লম্বা ও খাটো উদ্ভিদের পরীক্ষায় F, প্রজন্মের সবকটি উদ্ভিদ লম্বা হয়েছিল কারণ উদ্ভিদের লম্বা লক্ষণের অ্যালিলটি ছিল প্রকট। অপরদিকে যে জিনটি জীবের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে (বা ফিনোটাইপে) প্রকাশিত হয় না তাকে প্রচ্ছন্ন জিন বলে। আগের উদাহরণে সেটি ছিল খাটো উদ্ভিদের জিন।
মেন্ডেল-এর মতবাদ
মেন্ডেল নিজে কোনো মতবাদ প্রবর্তন করেননি, তিনি শুধু তাঁর গবেষণাপত্রে সংকরায়ণ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের তত্ত্বীয় ও পরিসংখ্যানিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে কার্ল করেন্স, যিনি মেন্ডেলের গবেষণার পুনরাবিষ্কার প্রকাশ করেছিলেন, মেন্ডেলের আবিষ্কারকে বংশগতির মৌলিক দুটি সূত্র হিসেবে উপস্থাপনের যোগ্য বলে প্রচার করেন। যেহেতু সূত্রদুটি মেন্ডেলের গবেষণার উপর ভিত্তি করে রচিত, তাই সূত্রদুটি মেন্ডেলের সূত্র নামে পরিচিত। উল্লেখ্য যে, মেন্ডেলের সময় আধুনিক জিনতত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়নি বলে জিনের ভূমিকাটিকে 'ফ্যাক্টর' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। নিচে মেন্ডেল-এর সূত্র দুটি বর্ণনা করা হলো।
মেন্ডেলের প্রথম সূত্র বা পৃথকীকরণ সূত্র (Law of Segregation):
সংকর (hybrid) জীবে বিপরীত লক্ষণের ফ্যাক্টরগুলো (জিনগুলো) মিশ্রিত বা পরিবর্তিত না হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে এবং জননকোষ সৃষ্টির সময় পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়।
আধুনিক জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা:
আমরা এখন এই সূত্র দিয়ে মেন্ডেলের লম্বা ও খাটো বৃক্ষের সংকরায়নের বেলায় F2 বংশধরের 3:1 অনুপাতকে ব্যাখ্যা করতে পারব।
ধরে নিই, লম্বা (tall) মটরশুঁটির জন্য দায়ী জিন হচ্ছে T এবং খাটো মটরশুঁটির জন্য দায়ী জিন হচ্ছে t; কাজেই বিশুদ্ধ লম্বা মটরশুঁটি গাছের অ্যালিল দুটি হবে IT এবং বিশুদ্ধ খাটো মটরশুঁটি গাছের অ্যালিল দুটি হবে tt। যেহেতু দুটি অ্যালিলই হুবহু একরকম তাই এই দুটি হোমোজাইগাস। আগের মতো আমরা ধরে নিই F, হচ্ছে প্রথম প্রজন্ম এবং F, দ্বিতীয় প্রজন্ম।
বিশুদ্ধ লম্বা (TT) মটরশুঁটি গাছের সঙ্গে অপর একটি বিশুদ্ধ খাটো মটরশুঁটি গাছের (tt) সংকরায়ণ ঘটালে দুটি গাছের পরাগায়নের সময় লম্বা গাছের T অ্যালিল খাটো গাছের। অ্যালিলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অপত্য গাছের অ্যালিলদুটি হবে Tt এবং আর কিছু হওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু লম্বা গাছের অ্যালিল T প্রকট গুণসম্পন্ন তাই F, F, বংশধরের সকল অপত্য মটরশুঁটি গাছের কাণ্ড হবে লম্বা। উভয় জিন দীর্ঘকাল একসঙ্গে থাকলেও বিনষ্ট বা একীভূত হয়ে যায় না বরং স্বকীয়তা বজায় রেখে অক্ষুণ্ণ থাকে।
F, প্রজন্মের গাছগুলো নিজেদের ভেতর পরাগায়ন করা হলে F, প্রজন্মের সম্ভাব্য জিনোটাইপগুলো হবে 2 TT, Tt, tT এবং tt (চিত্র ৮.৩)। T প্রকট অ্যালিল হওয়ার কারণে TT, Tt, tT গাছগুলো হবে লম্বা এবং tt গাছটি হবে খাটো। অন্যভাবে বলা যায় প্রকাশিত বৈশিষ্ট্য বা ফিনোটাইপের ভিত্তিতে F প্রজন্মের মাঝে লম্বা এবং খাটো গাছের অনুপাত যথাক্রমে 3:1।
চিত্র ৮.৩ : মনোহাইব্রিড ক্রসে দুই প্রজন্ম
F₂ প্রজন্মের সদস্যদের জিনোটাইপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ওটি প্রকট লক্ষণধারী (লম্বা) গাছের 2 মধ্যে 1টি হোমোজাইগাস (TT), বাকি দুটি হেটারোজাইগাস (Tt, tT)। যে খাটো লক্ষণটি (t) F, প্রজন্মে অপ্রকাশিত ছিল, F, প্রজন্মে হোমোজাইগাস (tt) হিসেবে তার প্রকাশ ঘটেছে। একইভাবে, যে শুদ্ধ হোমোজাইগাসটি (TT) F, প্রজন্মে অনুপস্থিত ছিল, সেটিও F₂ প্রজন্মে ফিরে এসেছে। এ থেকেই প্রমাণ হয় যে প্রথম F, প্রজন্মে T ও । একসঙ্গে থাকলেও পরস্পরের স্বকীয়তা বিনষ্ট হয়নি, শুধু গ্যামেট সৃষ্টির সময় পৃথক হয়ে গেছে।
মেন্ডেনের দ্বিতীয় সূত্র বা স্বাধীনভাবে মিলনের সূত্র (Law of Independent Assortment)
দুই বা ততোধিক জোড়া বিপরীত লক্ষণবিশিষ্ট গাছের মধ্যে সংকরায়ণ ঘটালে প্রথম প্রজন্মে (F₁) কেবল প্রকট লক্ষণগুলোই প্রকাশিত হবে, কিন্তু জননকোষ সৃষ্টির সময় লক্ষণগুলো জোড়া ভেঙে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র বা স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জননকোষে প্রবেশ করবে।
আধুনিক জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা:
এ সূত্র প্রমাণের জন্য মেন্ডেল দু জোড়া বিপরীতধর্মী লক্ষণসম্পন্ন উদ্ভিদের মধ্যে পরাগসংযোগ ঘটান। এমন দুটি শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত (হোমোজাইগাস) মটরশুঁটি গাছ নেওয়া হলো যার একটি গোল ও হলুদ বর্ণের বীজ এবং অন্যটি কুঞ্চিত ও সবুজ বর্ণের বীজ উৎপাদনে সক্ষম।
ধরা যাক, হলুদ লক্ষণের জিনের প্রতীক হচ্ছে Y (বড়ো অক্ষরের), সবুজ লক্ষণের জিনের প্রতীক হচ্ছে y (ছোটো অক্ষরের), বীজের গোল লক্ষণের জিনের প্রতীক হচ্ছে R, কুঞ্চিত লক্ষণের জিনের প্রতীক হচ্ছে, এবং আগের মতো প্রথম প্রজন্ম হচ্ছে F1 দ্বিতীয় প্রজন্ম হচ্ছে F2।
মেন্ডেল-এর মতে, প্রত্যেক বৈশিষ্ট্যের জন্য দুটি করে জিন দায়ী। অতএব প্রতি জিনের জন্য দুটি করে অ্যালিল হিসেবে হলুদ (YY) বর্ণের ও গোল (RR) বীজযুক্ত উদ্ভিদের জিনোটাইপ হবে YYRR এবং সবুজ (yy) ও কুঞ্চিত (rr) বর্ণের বীজযুক্ত উদ্ভিদের জিনোটাইপ হবে yyrr। কাজেই শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত দুইটি বীজের আকার এবং বর্ণের জন্যYYRR এবং yyrr জিনোটাইপের দুটি গাছের সংকরায়ণ করে যে অপত্য গাছ পাওয়া যাবে তার F, প্রজন্মের জিনোটাইপ হবে YyRr। যেহেতু হলুদ বর্ণের (Y) এবং গোলাকার (R) অ্যালিল, সবুজ (y) এবং কুঞ্চিত (r) বর্ণের অ্যালিলের উপর প্রকট তাই। বংশধরের সবকটি গাছের বীজ হবে গোলাকৃতির এবং হলুদ বর্ণের।
ডির ৮৪: ডাইহাইতিড ক্রসে দুই প্রজণ্ড
দ্বিতীয় সংকরায়ণের সময় F, বংশধরের YyRr জিনোটাইপের পুং ও স্ত্রী জনকোষ হতে পারে YR, Yr, yR এবং yr, এগুলো পরাগায়নের মাধ্যমে মিলিত হয়ে 4 4 16 ধরনের জিনোটাইপ তৈরি করতে পারে (চিত্র ৮.৪)। এরমাঝে গোল-হলুদ, কুঞ্চিত-হলুদ, গোল-সবুজ এবং কুঞ্চিত-সবুজ এই চার ধরনের বৈশিষ্ট্য বা ফিনোটাইপ হওয়া সম্ভব। যেহেতু গোলাকার (R) এবং হলুদ বর্ণের (Y) অ্যালিল, কুঞ্চিত (r) এবং সবুজ (y) বর্ণের অ্যালিলের উপর প্রকট তাই আমরা দেখতে পাই 16 ধরনের জিনোটাইপের ভেতর ফিনোটাইপ গোল-হলুদ ও বার, কুঞ্চিত-হলুদ ও বার, গোল-সবুজ ও বার এবং কুঞ্চিত-সবুজ 1 বার পাওয়া যায়। অর্থাৎ এদের অনুপাত 9:3:3:1, ঠিক যেমনটি মেন্ডেল দেখেছিলেন।
৮.৪ জিনতত্ত্ব ও বংশগতিবিদ্যার সম্পর্ক
ইতোমধ্যেই তোমরা জেনেছ যে বংশগতি বা হেরিডিটি (Heredity) হলো বাবা-মা হতে বংশানুক্রমে সন্তান-সন্ততিতে জিনগত বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হওয়া। এর ফলে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জীববিজ্ঞানের জিনতত্ত্ব (Genetics) শাখায় বংশগতি সম্পর্কিত নানাবিধ বিষয়াদির বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করা হয়। বিজ্ঞানী উইলিয়াম বেটসন (William Bateson) 1906 সালে প্রথম Genetics শব্দটি ব্যবহার করেন যা গ্রিক শব্দ Genno থেকে উদ্ভূত, যার ইংরেজি অর্থ to give birth
গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল তাঁর সংকরায়ণ পরীক্ষার ফল থেকে বুঝতে পারেন যে কোনো জীবের প্রতিটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটি উপাদান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। এ উপাদান জীবদেহে জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে এবং হ্যাপ্লয়েড গ্যামেট গঠনকালে ঐ উপাদান সংখ্যায় অর্ধেক হয়ে যায়। কিন্তু উপাদানটি কী, গ্যামেটের কোথায় এটি অবস্থিত এবং এসব উপাদান কীভাবে বংশপরম্পরায় বৈশিষ্ট্যগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে-এসব বিষয়ে মেন্ডেল অবগত ছিলেন না। 1900 সালে মেন্ডেল তত্ত্বের পুনরাবিষ্কারের পর ক্রোমোজোম ও মেন্ডেলের উপাদানের মধ্যে বেশ কিছু মিল দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ক্রোমোজোমের আকৃতি ও দৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা এবং দেহকোষে সেগুলো জোড়ায় জোড়ায় থাকে। জোড়ার একটি পিতার কাছ থেকে, অপরটি মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। মানুষের বেলায় দেহকোষের 46টি ক্রোমোজোমের 23টি আসে পিতার কাছ থেকে, বাকি 23টি মায়ের কাছ থেকে। শুধু শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মধ্যে 46টি বা 23 জোড়ার পরিবর্তে 23টি ক্রোমোজোম থাকে। এই দুটি কোষের মিলনে 46টি ক্রোমোজোম নিয়ে জাইগোট কোষের সৃষ্টি হয়, যেটি কোষ বিভাজনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ জীবে পরিণত হয়।
মেন্ডেল একটি বৈশিষ্ট্যের জন্য একজোড়া ফ্যাক্টর বা উপাদানের কথা বলেছিলেন, যার একটি পিতা ও একটি মাতার কাছ থেকে আসে, যেমনটি ক্রোমোজোমের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। 1902 সালে বিজ্ঞানী সাটন (S.W. Sutton) ও বোভেরি (T. Bovery) পৃথকভাবে ক্রোমোজোম ও মেন্ডেলের উপাদানের মধ্যে মিলের কথাটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। এ নিয়ে প্রায় এক যুগ ধরে বিভিন্ন জীবজন্তুর উপর গবেষণা চলেছে। পরে দেখা গেল যে মেন্ডেলের উপাদান বা জিনের অবস্থান ক্রোমোজোমে, তাই বংশানুক্রমিক গতিপ্রকৃতির বিষয়ে ক্রোমোজোম আর উপাদানের মধ্যে এত সাদৃশ্য। গবেষণার ফলাফল থেকে তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে জিন ও ক্রোমোজোম অনেক দিক দিয়ে একই রকম আচরণ করে। তাছাড়া বংশগতি নির্ধারণের সময় জিন ও ক্রোমোজোম অভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করে। একেই বংশগতির ক্রোমোজোম তত্ত্ব বলা হয়।
Read more